অবেলায় মেঘ ভেসে যায় (২য় পর্ব )
অবেলায় মেঘ ভেসে যায় (২য় পর্ব )
আষাঢ় মাসটি প্রায়ই শেষের দিকে। সামনে শ্রাবণ মাস। দীর্ঘ দুই মাস বৃষ্টির পানি, জোয়ারের পানি ও দেশের বাইরের পানি এসে ভরপুর বাংলাদেশ। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এ গ্রাম নয়, এ পারা নয়, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি নৌকা ব্যতীত যাওয়া যায় না। সবার আমার নৌকা নেই। তাই অনেকেই কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করেছে। এ ভেলা দিয়েই তারা নৌকার চালায়। রমিজ শিমুল এদের কি উপায় হবে? এখন আর আগের মতো কাজ নেই। তারা বসে বসে সময় কাটায়। কিন্তু বসে বসে থাকলে তো আর হবে না। কিছু একটা করতে হবে। তাই তারা কয়েক রকমের জাল কিনলো। এই জাল দিয়ে তারা মাছ ধরবে। সব জায়গায় আবার জাল ফেলা যায় না। বেশিরভাগ জায়গায় আমন ধান রোপণ করা হয়েছে। তাই দেখে দেখে ফাঁকা জায়গা ও আমন ধানের আইলগুলোর মাঝখান দিয়ে জাল ফেলা হয়। এই জালের মাছ বিক্রি করে তারা কোনরকম দিন চালায়। তাদের মাছ ধরা দেখে রায়াত তার বাবাকে বললো, আব্বা আমারে কয় ছড়া জাল কিনা দাও। নিতুল রমিজ কে বলল, রমিজ,তুই আমারে কয় জোড়া জল দিস। রমিজ মাথা নেড়ে বলল, আইচ্ছা। আউশ আমন ধান গুলো বড় হয়েছে। তাই সব জায়গায় জাল ফেলা যায় না। রায়াত কলাগাছ দিয়ে একটি ভেলা তৈরি করল। এরপর ক্ষেতের আইল গুলোর আগাছা পরিষ্কার করল।
এরপর রায়াত সেই পরিষ্কার জায়গায় জাল ফেলল। রায়াত ভেলা দিয়ে বাড়ির আশেপাশে জাল ফেলে। আর রমিজ, যেখানে জাল পাওয়া যায় সব তার জাল। নিজেদের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে গিয়ে ও জাল ফেলে। রায়াত জাল ফেলে এসে সবাইকে ডাকল গোসল করার জন্য। ভাই এসে জড়ো হলো রাস্তার মাঝখানে। রাস্তাটি ডুবে সেখানে গলা পানি হয়েছে। সেখান থেকে তারা ছোঁয়াচে খেলা শুরু করলো। পানিতে প্রচুর স্রোত ও ধার ছিল। সাঁতরিয়ে একপাশ থেকে আরেক পাশে আসা-যাওয়া করা যায় না। নিপেনদের বাড়িতে এখন হাঁটুপানি। তাই ও এখন রায়তদের বাড়ির এদিকে কম আসা যাওয়া করে। এদিকে বেলির ভাই ধারের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। ধারের মধ্যে এঙ্গার খালে সে ডুবতে ছিল। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। তাদের মধ্যে থেকে হঠাৎ মনির দেখতে পেল বেলীর ভাইকে। তাকে দেখে সবাই অনেক ভয় পেল। কিন্তু সে খুব কষ্ট করে অন্য দিক দিয়ে পারে ফিরল। তার এই কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে সবাই বাড়ি চলে গেল।
আজকে রাতে পরিপূর্ণ জোসনা উঠেছে। যারা জাল ফেলে, তারা রাত জেগে পাহারা দেয়। আবার অনেকে ডাকাতের ভয়ে রাত জেগে থাকে। কেউ নৌকার উপর বসে পাহাড়া দিচ্ছে কেউবা ভেলার উপর বসে পাহাড়া দিচ্ছে। পাহারা দিচ্ছে এজন্য যে অনেকে জল থেকে মাছ নিয়ে নেয় চুরি করে আবার অনেকে পুরো জাল টাই চুরি করে নিয়ে নেয়। রমিজ তার হাতের টর্চ বাতি দূরে ইশারা করে দেখে। হঠাৎ দেখে একটি বড় নৌকা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এটা দেখে রমিজ চেঁচামেচি শুরু করলো। চেঁচামেচিতে রায়াতের ঘুম ভেঙে গেল। রায়াত তার মাকে জিজ্ঞেস করল, কি ওইছে গো মা? রায়াতের মা ভয়েভয়ে চুপে চুপে বলল, এহন কিছু হইছে না, মুনই ডাকাত পড়েছে। রায়াত বাড়ির বাইরে গেল। এবং রমিজের সাথে গেল। নৌকার কাছে গিয়ে তো রমিজ অবাক। দেখল মাঝিপাড়া থেকে মাঝিরা এসেছে মাছ ধরতে। রমিজ রেগে গিয়ে বলল, এই রাইতে মাছ ধরবার আইছত, আর সুময় পাইলি না? জাল জেডি ছিরছত সব জরিমানা দিবি।
রায়াতের মন খারাপ। রায়াতকে দেখে রমিজ বলল, তোর আবার কি অইল? রায়াত জবাব দিল, আমার জালের কি অইবো? রমিজ বলল, তোর এত চিন্তা করন লাগবো না। তবু রায়াতের মন খারাপ। নিপেন তার ঘরের জানালা দিয়ে সবকিছু দেখতেছে। কিন্তু সে কিছু শুনছে না। রমিজ মাঝিদের কাছে গিয়ে ঝগড়া করে কিছু টাকা নিয়ে আসল। এরপর সবাই বাড়ি এসে শুয়ে পড়ল। কিন্তু রায়াত বাড়িতে আসলো না। জোসনা রাত, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রায়াত সারা রাত বসে রইল তার ভেলার উপর। রায়াত বসে এদিক ওদিক তাকায়। সে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
রায়াত খুব মনোযোগ দিয়ে পরিবেশ উপভোগ করছে। সে ভেলার উপর বসে চারিদিক তাকিয়ে দেখছে আর পানি দিয়ে খেলছে। হঠাৎ করে ছোট ছোট মাছগুলো পানির উপরে উঠে আমার সাথে সাথে চলে যায়। দুই পা পানিতে নামিয়ে ফেলার ওপর বসে সময় কাটায়, আবার শুয়ে থাকে, এভাবে সারারাত পার করলো রায়াত। সকালবেলা রমিজ জাল দেখতে যাবে। বাড়ি থেকে নেমে পানিতে নামতেই দেখে রায়াত ভেলার উপর ঘুমিয়ে আছে। রমিজ রাজা কে জিজ্ঞেস করল, এহন এনে হুইয়া রইছত ক্যান? রাতের ঘুমের ভাব এখনো কাটেনি। সে ঘুম থেকে উঠে লম্বা একটি হাই তুলে বলল, রাইতে হুইছিলাম, ব্যাত আর যাই নাই। রমিজ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাত যা, তোর জাল আমি দেইকা মাছ নিয়া আহুমনি। এই বলে রমিজ রাতের বেলা নিয়ে চলে গেল জাল দেখতে। রমিজ জাল দেখতে দেখতে অনেক দূরে চলে গেল। কিছুক্ষণ বসে থেকে রায়াত বাড়িতে ফিরে আসলো। বাড়িতে এসেই শুনে সৌরবি কে দেখার জন্য পাত্রপক্ষ আসবে। কথাটি শুনে রায়াত আবার গেল রমিজ কে ডাকতে গেল। ঘাটে একটি নৌকা বাঁধা ছিল। খুব দ্রুত গতিতে নৌকা নিয়ে রায়াত রমিজের নিকট পৌঁছালো। খুব অস্থির হয়ে রায়াত রমিজ কে বলল, কাক্কা, আইজকা ব্যাত ইষ্টি আইবো, আপনে এহনি ব্যাত যানগা। কথাটি শুনে রমিজ বাড়ির দিকে রওনা হলো। রায়াত ও তার পিছু পিছু আসলো বাড়িতে। রমিজ বাড়িতে এসে সৌরভের মাকে সব কিছু জিজ্ঞেস করল। এরপর তাকে টাকা বের করে দিতে বললো। রমিজ টাকা নিয়ে বাজারে গেল বাজার করতে। এদিকে বাড়িতে অনেক কাজ তৈরি হলো নতুন করে। রায়াত সেসব ঝামেলা সামলালো। দুপুরবেলা বরপক্ষ এল। তাদের আপ্যায়ন করা হলো। মেয়ে দেখানো হলো। অর্ধবৃত্ত করে বর পক্ষের লোকেরা বসে আছে,অন্য পাশে বসে আছে সৌরবি । তাকে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। বাবার নাম মায়ের নাম এবং ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে। মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। ছেলেও পছন্দ হয়েছে, ছেলে পছন্দ হবার বড় একটি কারণ হচ্ছে, মেয়েটিকে বিয়ে দিতে পারলে রমিজের খরচ কমে যাবে। এবার মূল কথার জন্য মুরুব্বিরা বসলো। রমিজ রায়াত কে ডেকে বলল, সোলারে, আরো যারা আছে ব্যাকরেই ডাইকা নিয়া আয়। রায়াত সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলো। শুরু হলো মূলকথা। ছেলে পছন্দ হইছে মেয়ে পছন্দ হয়েছে এখানে আবার মূল কথা কি। মূলকথা একটাই সেটি হল যৌতুক। যৌতুকের কথা শুনতেই ছোলা, ভোলা সবাই রমিজের দিকে তাকিয়ে রইল। রমিজ ঘাড় নাড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিলো তারা যে ফয়সালা করবে সেটা সে মেনে নেবে। কেন মেনে নেবে না, কারণ সবকিছু ব্যবস্থা তো তারাই করবে রমিজের শুধু মেয়ের বাবা হিসেবে কাগজ-কলমে নাম থাকবে। ছেলের বাড়ির পক্ষ থেকে একজন বলে উঠল, মাশাল্লাহ, আমগো মাইয়া ভাল্লাগছে, আমগো কোনো দাবি দাবা কোন চাওয়া ন্যাই। তুমগো মাইয়া যাতে ভালো থাকে হেল লাইগা কিছুতো দেওন নাগবো। আরেকজন তাকে সমর্থন করে বলল, হ মিয়া, তুমি ঠিকি কইছ, পুলারে নাও কিননের লাইগা ৫০০০ টাহা আর সাইকেল কিনবার নিগা ৫০০০ টাহা দিবেন, আগের ব্যক্তিটি এর সাথে যোগ করে বলল, একখান পালঙ্ক দিওন নাগবো। লোকটি আবার হাসি দিয়ে বলল, এই জিনিসতো তোমগো মাইয়ারি থাকপ। সোলা চোখ বন্ধ করে উত্তর দিল, এইডা কোন কতা, আমান একটা টাক চাপাইয়া দিলান মিয়ারা। কিছুক্ষণ আলাপন ও তর্কাতর্কির পরে শুধু পালঙ্কটা মাপ পেলেন রমিজ। পরিশেষে এই সিদ্ধান্ত হলো যে, ছেলেকে ১০টাকা দিতে হবে। আজকে সোমবার। এই বৈঠকে বসেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। সামনের রবিবার বিয়ে। ছেলে পক্ষের লোক চলে গেল।
রমিজের নিকট এক টাকাও নেই। সে দিন আনে দিন খায়, যেদিন কোনো উপার্জন হয় না সেদিন না খেয়ে থাকে। জমা বা সঞ্চয় বলতে তার কোন টাকা পয়সা নেই। এত টাকা সে কোথায় পাবে। ১৫০০ টাকা দিল তার এক বন্ধু, নাম তার আজিজ । তার বাড়ি পূর্ব পাড়া। তার সাথে রমিজের আগে থেকে বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধুত্ব বলতে সে আজিজের বাড়িতে কাজ করে দিতো। গ্রামে থেকে সবাই কিছু কিছু টাকা দিয়ে ৭০০০ টাকা উঠিয়ে দিলো। এই হল ৮৫০০ টাকা। আর বাকি রইল পনেরশো টাকা। এই এক সপ্তার মাছ বিক্রি করে রমিজ পনেরশো টাকার ব্যবস্থা করতে পারবে। তাহলে তো সমাধান হয়েই গেল। কিন্তু না, বিয়ের মধ্যে যে অন্যান্য খরচ সেগুলোর টাকা কোথায় পাবে। সব পথ অবলম্বন করে ১০০০০ টাকার ব্যবস্থা হল। আর তো কোন রাস্তা বাকি নেই। এই মুহুর্তের রায়াত বলে উঠলো, চিন্তা কইরোনা রমিজ কাকা, এই টাহা আমি দিমুনি। রায়তের কথার কেউ গুরুত্ব দিলো না। কিন্তু রমিজ রায়াতের কথায় আশ্বাস পেল। নিতুল রায়াতের কথা শুনে খুব রাগ করলো । ও এত টেহা পাব কোনে? এই বলে রাগ করে নিতুল চলে গেল। তবে আর কথা না বাড়িয়ে সবাই বৈঠক শেষ করে দিল। রাতের বেলায় রায়াত নিপেন কে ডেকে নিয়ে আসলো। এরপর তারা বড় সড়কে চলে গেল। রাস্তায় কিছুক্ষণ বসে রইল। রাস্তা দিয়ে দুইটা লোক যাচ্ছিল সাইকেল চালিয়ে। রায়াত তাদের দাঁড় করালো। এবং খুব মায়াবী মুখে ক্রন্দন স্বরে তাদেরকে বলল যে তারা খুব বিপদে পড়েছে, সামনের বাজারে তাদের জন্য একজন লোক অপেক্ষা করতেছে, খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে না পারলে বড় বিপদ হবে। এই বলে তারা লোক দুটোর সাইকেল নিয়ে গেল। তারাও খুব সহজে রাজি হল, কারণ রায়াতের অভিনয়টা ছিল নিখুত। কিন্তু রায়াত ও নিপেন সাইকেল দুটি চালিয়ে চলে গেল অন্যদিকে। লোক দুজন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। এরপর আর তাদের কোন খবর পাওয়া গেল না। খুব ভোরবেলা রায়াতও নিপেন সাইকেল নিয়ে চলে গেল বড় বাজারে। সেখানে তারা সাইকেল দুটি তিন হাজার টাকা বিক্রি করল। এই তিন হাজার টাকা রায়াত রমিজের হাতে দিল আর বলল, এইডাই কাকা, আর পারলাম না। এই বলে তারা চলে গেল। রমিজ টাকা হাতে নিয়ে টাকার দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই টাকায় হবে না। তাই সে ২ হাজার টাকা সুদ নিল। রমিজ সবার সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করল। সামনের বুধবার। সামনের বুধবারে সৌরবির বিয়ে ঠিক করা হলো। দেখতে দেখতে বুধবার চলে আসলো। আজকে সত্যিই মৌলভীর বাড়ির দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে এরা সবাই এক পরিবারের লোক। কে খেতে পেল কে খেতে পেল না, কে কম পেল কে বেশি পেল এ নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। সবাই যার যার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত আছে। দুপুরবেলা লোকজন আসলো সবাই। খাওয়া দাওয়া করে সন্ধ্যার পর সৌরভীকে নিয়ে চলে গেল বরপক্ষ। রমিজ সহ আরো কয়েকজন মন খারাপ করে বসে আছে। খুব ঝামেলার মধ্যে বিয়েটা শেষ হলো। এখন রমিজের সংসারের খরচ আগের থেকে একটু কমে গেল। কিন্তু পরক্ষণে রমিজের মাথায় চিন্তা আসলো যে টাকা সৌরভিড় পেছনে খরচ হতো সেই টাকা সুদ দিতে হবে। রমিজ সব সময় চিন্তায় থাকে কিভাবে সুদের টাকাগুলো পরিশোধ করবে।
পরের দিন সকাল বেলা। রায়াত তার ভেলা নিয়ে ছুটলো। অনেক দূরে চলে গেল রাইত। রায়াত জাল ফেলে কিছুদূর গিয়ে ভেলার উপরে বসে রইল। তার ভেলার মধ্যেই ছিল বড়শি। সে ভেলায় বসে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে লাগলো । রায়াতের বড়শিতে মাছ আসলো না। তাই মাছ আসার জন্য রায়াত পানির উপর কি কি যেন ফেলল । কিছুক্ষণ পর ম্যাজিকের মত অনেকগুলো মাছ ধরল রায়াত। কিছুক্ষণ বসে থেকে রায়াত ভালো মাছ ধরল । দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে আসলো। দুপুরের রোদে রায়াতের গা গরম হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। রায়াত এবার মাছ ধরা বন্ধ করলো । সে বাড়িতে আসার জন্য ভেলা প্রস্তুত করলো। আসার সময় দেখল ধান ক্ষেতের ভিতরে অনেকগুলো শাপলা ফুল ফুটে আছে। সেখান থেকে কিছু শাপলা সে তুলে নিয়ে আসলো। এবার রায়াত বাড়ির দিকে আসলো। আসার সময় সে বাবরার পেয়ারা গাছ থেকে অনেকগুলো পেয়ারা ও নিয়ে আসলো। যত পারলো পেয়ারা খেয়ে নিল সে। কিছুক্ষণ পর তার পেট ব্যাথা শুরু হলো। তবু সে ছাড় দিল না। গাছের সব পেয়ারা সে নিয়ে আসলো। ভেলাটি ছোলার বাড়ির সামনে বেঁধে রেখে বাড়ির দিকে আসছে রায়াত। সোলার বাড়ির উপর দিয়ে যাচ্ছে রায়াত। কিন্তু রায়াত সোলার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। রায়াতের হাতে শাপলা দেখে ছোলার চোখ কপালে উঠলো। সোলা রায়াতকে ডেকে বলল, কিরে রায়াত, সাবলাডি ২ টাহাই দিবি? রায়াত নিজের মুখটা ভেংচি মেরে বলল, যাও, তোমার কোন বোনের জামাই সাবলা নিয়া বইয়া রইছে, হেঁন থেকে নিয়া আহ।
ভোলার বউ জিজ্ঞেস করল, এত সুন্দর সাবলা কনে থিকা আনলি? রায়াত জবাব দিল, তুইলা আনছি কাক্কি। এরপর রমিজের বাড়ির উপর দিয়ে হেটে হেঁটে রায়াত চলে গেল। রায়াতের বাড়িতে কেউ নেই। রায়াত বাড়িতে শুয়ে রইলো। কিছু সময় পর রায়াাত খুব চেঁচামেচি শুনতে পেল। ঘর থেকে বের হয়ে আসলো রায়াত। সে শুনতে পেল রমিজের বাড়ির দিকে চেচামেচি হচ্ছে। এগিয়ে গেল রায়াত। দেখে রুমিজের মা চিল্লাচিল্লি করতেছে। রায়াত জিজ্ঞেস করল, কি অইছে বুজি? রমিজের মা উত্তর দিল, কি আর অইবো, আমাগো ডকি গেছাল নাহাইবার, খার পাগারে গেছে নাহাইবার। ওতো জানেই ঐ পাগারে ভূত আছে, এতো পানির মধ্যে ও গেছে ক্যা, ভূতেরে খাওয়াবার গেছাল।
রায়াত বুঝতে পারল
এ গ্রামের মধ্যে পাট চাষে বিখ্যাত রিপন ও মলিন। রিপনের ঘর রমিজের ঘরের উত্তরের ঘর। আর মলিনের বাড়ি সরকার বাড়ি। রমিজের বাড়ি থেকে কিছু দূর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে হেটে যেতে হয়। রিপন ও মলিনের মতো পরিশ্রম অন্য কেউ করতে পারতো না। একই পরিবেশে একই জমিতে অন্যরা যে পরিমান পাট চাষ করে রিপন ও মলিন তার থেকে অনেক বেশি পাট পায়। প্রায় দ্বিগুন।
এখন পাট কাটার সময় হয়েছে। পাটগুলো পানির জন্য কাঁটা মুশকিল। নৌকা ছাড়া কাঁটা যাবেনা। তাদের দুইজনের একজনেরও নৌকা নেই। তাই নৌকা ভাড়া করতে হবে তাদের। রিপন ও মলিন একত্রে একটি নৌকা ভাড়া করলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সময়ের জন্য পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে নৌকার মালিক কে। তাদের জমি পাশাপাশি না হওয়ায় তারা একত্রে নৌকা ব্যবহার করতে পারলোনা। এরজন্য একদিন মলিন ব্যবহার করে পরের দিন রিপন। পানি পঁচে গেছে সেই সাথে আরো কত আবর্জনা পঁচে গেছে। সব মিলিয়ে পানিতে প্রচুর চুলকানি। শরীরের কিছু অংশ কিছু সময় পানিতে রাখলেই চুলকানিতে পাগল হয়ে পরতে হয়। নৌকায় করে দুজনেই পাট ক্ষেতের দিকে গেলো। দুইজনেই হাতে পায়ে, মুখে, শরীরের সব জায়গায় এক ধরণের ঔষধ মালিশ করে নিলো। এতে করে কিছুটা হলেও কম চুলকাবে। রিপন ফুলপ্যান্ট ও ফুল হাতা শার্ট গায়ে পড়েছে। মলিন লুঙ্গি আর পাতলা একটা গেঞ্জি। এরপর রমিজ নৌকা থেকে নেমে তার জমির দিকে হেটে যাচ্ছে। কোমরের উপর পর্যন্ত পানি, দুই হাত দিয়ে রিপন সামনের ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে সামনের দিকে যাচ্ছে। মলিন নৌকা নিয়ে তার জমির দিকে গেলো। রিপন তার জমির কাছে পৌঁছে গেছে। আর মলিন পাট কাঁটা শুরু করে দিছে। দুইজন দুইজনকে দেখতে পাচ্ছে আর জোরে কথা বললে তা শুনতেও পাচ্ছে। রিপন জিজ্ঞেস করলো, ভাই পাট কেমুন কাটে, মেলা সুময় নাগে নিহি? মলিন উত্তরে বললো, আইগাই নারে, মেলা সুময় নাগে, পানিয়ে জব্বর কামড়াই। কৌতূহল নিয়ে মলিন জিজ্ঞেস করলো, তোর কি খবর? এক ডুবে দুই আতার বেশি পাট কাটন যায়না। মলিন সম্মতি দিয়ে বলল, হ, কাটতে থাক। দুইজনে মনোযোগ দিয়ে পাট কাটতে লাগলো। মাঝেমাঝে তারা কথা বলে। মলিন একটু পর পর নৌকায় বসে বিড়ি পান করছে আবার নেমে পাট কাটছে। রিপন একভাবে কেটেই যাচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত তারা অনেক পাট কেটে ফেললো। দুপুরের খাবার খেতে তারা বাড়িতে আসবে। মলিন তার পাট নৌকায় তুলে নিলো। রিপনের কাঁটা পাট সেখানেই রেখে আসলো। আগামীকাল নৌকা ব্যবহার করবে রিপন। তখন তার পাট নিয়ে আসবে। আসার সময় রিপন নৌকায় উঠে বসলো। দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়িতে আসলো। এভাবে তারা দুইদিন পাট কেটে একত্রিত করে এবং সেগুলো পঁচানোর জন্য রেখে দেয়। পাট পঁচানোর জন্য পানির উপর কিছু পাট রেখে দেয়, তার উপর আরো পাট, তার উপর আরো পাট রাখলো। এরপর সেই পাট কিছু আবর্জনা ও কিছু আগাছা দিয়ে ঢেকে দিলো। তারপর পাটের উপর মাটি দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখলো। এভাবে মলিন ও রিপন পাশাপাশি পাট পঁচানোর জন্য রেখে দিলো। আবার পরোক্ষনে চলে যায় পাট কাটতে। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহের মতো তারা পাট কাটলো ও সেই পাট পঁচাতে দিয়ে রাখলো।
বিশ -থেকে পঁচিশ দিন পর রিপন পাটগুলো দেখতে গেলো সেগুলো পঁচেছে কি না। রিপন কয়েকটি পাট টেনে বের করলো এবং দেখলো সেগুলো থেকে চামড়া আলাদা করা যায় কিনা। হুম, পাটগুলো ঠিকমতো পঁচেছে। নিজের সাথে নিজেই কথা বললো রিপন। এরপর রিপন বাড়ি ফিরতেছিলো। পথে মলিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। রিপন বললো, ভাই, তোমারেইতো বিরচাইতাছি। ক্যান, কি অইছে! জবাব দিলো মলিন। আবার বললো রিপন, ভাই, পাট তো জাগ আইছে। কস কি, কি রহম অইছে, আঁশ কি আলাদা করণ যাবো? জিজ্ঞেস করলো মলিন। রিপন উত্তর দিল, হ, আমি অহন দেইকা আইলাম। তাইলে নু কালকা পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাম শুরু করি, বললো মলিন। হ, আমি তাই করমু, জবাব দিলো রিপন। তাইলে ওই কতায় রইল, এই কথা বলে দুজন দু দিকে চলে গেলো।
রিপন একা সব পাট শেষ করতে পারবে না। রমিজ ও শিমুলকে রাতের বেলায় বলে রাখলো তার কাজ করার জন্য।
সকাল বেলা সবার জন্য একটি নতুন দিন শুরু হলো। কাজ দেখে যেন এরা কেউ ভয় পায়না। কাজে ব্যাস্ত থাকলে এদের সবার মধ্যে অনেক বেশি আনন্দ লাগে। রমিজ একটি শার্ট আর একটি পরিত্যক্ত ফুল প্যান্ট পরে হাতে দুটি বাঁশ নিয়ে গেলো পাটের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখে আরো কয়েকজন এসে বসে আছে। সেখানে শুধু পুরুষ মানুষ নয়, আছে মহিলাদের ভীড়, সেই সাথে ছোট শিশুদের ভীড়। তারাও এসেছে পাটের কাজ করতে। রমিজ রিপনের হাত থেকে কয়েকটি রশি নিয়ে পানিতে নামলো। পানির উপর একটি বাঁশ রাখলো আর দুটি বাঁশ লম্বা করে পানির নিচে মাটিতে পুঁতে খুটি হিসেবে তৈরী করলো। একটু দূরে একই ভাবে মলিন কাজ শুরু করে দিছে। রিপন পানি থেকে পাটগুলো তুলে রমিজের নিকট এনে জমা করছে। রমিজ আর শিমুল পাট থেকে পাটের আঁশ আলাদা করছে। আঁশ গুলো আলাদা করে জমা করে রাখছে। দুইপাশে নিচু খেত। পানিতে তলিয়ে গেছে, শুধু রাস্তাটা জেগে আছে। সেই রাস্তার পাশে বসে বাড়ির মহিলারা পাটের কাজ করছে। সেখানে আছে রায়াতের মা, বেলির মা, রমিজের বৌ সহ এ বাড়ির সব মহিলা। মহিলাদের সাথে চুক্তি হলো তারা যতগুলো পাট থেকে আঁশ আলাদা করবে ততটা পাট কাঠি নিবে আর পাটের আঁশ রিপন কে দিয়ে যাবে। বাড়ির ছোট ছোট শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করছে, কেউবা কান্না করছে । রিপন পাট কাঠিগুলো বাড়িতে নিয়ে রোধে শুকাতে দিচ্ছে। মলিনকে কাজে সাহায্য করছে তার ছেলে ও তার স্ত্রী। এইভাবে কয়েকদিন যাবৎ কাজ করে পাটের কাজ শেষ হলো।
অবেলায় মেঘ ভেসে যায় প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন