শিশুর যত্ন কিভাবে নিতে হয়
শিশুর যত্ন
শিশু বা সন্তান প্রত্যেকটি বাবা-মায়ের জন্য সর্বোচ্চ দামি জিনিস। একটি দাম্পত্য জীবনে যদি তাদের সন্তান না থাকে তবে তাদের যত কিছুই থাকুক পৃথিবীতে তাদের মধ্যে দুঃখী মানুষ কেউ নাই। বাবা মা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সন্তানকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক অজ্ঞতার কারণে ভাই কিছু না জানার কারণে অনেক বাবা-মা শিশুর যত্ন নিতে গিয়ে অনেক বড় বড় ভুল করে ফেলে। যার ফল শিশুর ক্ষতি বয়ে আনে। তাই সঠিকভাবে শিশুর যত্ন নিতে হবে।
শিশুর যত্ন কেন প্রয়োজন
প্রত্যেকটি শিশুর যত্ন নেয়া প্রয়োজন। ছোটবেলায় শিশুদের যত্ন সঠিকভাবে নিলে বড় হয়ে সেই প্রভাব তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। শিশুর যত্ন ও পুষ্টি ছোটবেলায় সময় মত ওর সঠিক পরিমাণে না দিতে পারলে বড় হয়ে তার মধ্যে অনেক সমস্যা বা রোগ ব্যাধি দেখা দিতে পারে। প্রত্যেকটা পরিবারের উচিত তাদের পরিবারের শিশুদের সঠিকভাবে সঠিক যত্ন নেওয়া।
শিশুর যত্নের গুরুত্ব
শিশুর যত্নের গুরুত্ব অপরিসীম এটা আমরা সবাই জানি। শুধু শিশু নয় প্রত্যেকটি জিনিসেরই যত্নের গুরুত্ব অপরিসীম। যত্নহীন কোনদিনই ভালো থাকেনা। যত্নহীন কোন জিনিস মজবুত থাকে না এবং বেশিদিন টিকেও থাকে না। যে জিনিসের যত্ন বেশি সেই জিনিস তত মজবুত ও টিকসই হয়। আর শিশুরা কেবল তো তাদের জীবনের শুরু মাত্র। একটি গাছ যেমন রোপন করার পর সেটির বেশি বেশি পরিচর্যা করতে হয়, ঠিকমতো পানি দিতে হয় ঠিক মত পরিচর্যা করতে হয় তবে গাছটি বড় ও মোটা হয়। ঠিক তেমন মানুষের জীবনে একই পদ্ধতি। একটি মানুষের জীবন যখন শুরু হয় অর্থাৎ শিশু বয়সে তার যত্ন এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই সময় শিশুদের যত বেশি গুরুত্ব ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হবে তারা তত বেশি শক্তিশালী মেধাবী হবে।
কিভাবে শিশুর যত্ন নেবো
একটি শিশুর যত্ন বিভিন্নভাবে নেওয়া যায়। বিভিন্নভাবে যত্ন নেওয়ার মধ্যে তার শারীরিক যত্ন আছে, খাবার দাবার সবদিক দিয়ে একটি শিশুর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
১. নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা :
শিশুকে যত্ন নেওয়ার আগে বা শিশুকে লালন-পালন করার আগে সবসময় নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে। আপনি যখন আপনার শিশুকে কোলে নিবেন, কিংবা আপনার শিশু সাথে সময় কাটাবেন, অথবা তার যত্নের জন্য অন্যান্য কোন কাজ করবেন তখন আগে আপনার নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বিশেষ করে আপনার হাত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। এছাড়া শিশুর বিছানা পত্র এবং নিজেদের বিছানা পত্র এবং ব্যবহার করার আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. শিশুকে খাওয়ানোর সময়:
শিশুকে সঠিক সময়ে খাওয়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতক শিশুকে প্রতি ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পরপরই খাওয়ানো উচিত। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ৮-১২ বার শিশুকে দুধ খাওয়াতে হতে পারে। শিশুর প্রথম ৬ মাসে শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। মায়ের দুধে রয়েছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি এবং অ্যান্টিবডি, যা শিশুর বর্ধন এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। অনেক সময় বাচ্চারা বিভিন্ন কারণে দুধ পায়না কিংবা খেতে পারেনা। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে হবে। সেক্ষেত্রে কেনার আগে অবশ্যই দুধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারি, সঠিক পরিমাণ এবং দুধের গুণগত মান যাচাই করে নিন। আর যদি কেনা দুধ খাওয়ানোর ফলে শিশুর কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
৩. শিশুর জিব্বা পরিষ্কার রাখুন :
শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর কারণে শিশুর জিহ্বার মধ্যে সাদা এক ধরনের আস্তরণ পরে যায়। শিশুর জিহ্বার এ আস্তরণ ঠিকমতো পরিষ্কার না করলে মুখের মধ্যে ঘা হওয়া সম্ভাবনা থাকে।
৪. শিশুদের চোখের যত্ন :
শিশুদের চোখের প্রায়ই ময়লা দেখা যায়। বাচ্চার চোখের ময়লা পরিষ্কার করতে ভুলেও খালি হাত ব্যবহার করা যাবে না। কুসুম গরম পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে নিন। এবার হালকা করে চেপে পানি ঝরিয়ে বাচ্চার চোখ আলতোভাবে মুছে নিতে হবে।
৫. শিশুদের হাতের নখ কাটা :
শিশুদের হাতের নখ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এবং তাদের নখের ভিতর অনেক ময়লা আটকে থাকতে পারে। শিশুরা খুব দ্রুত তাদের আঙ্গুলগুলো মুখের বেতন নেয়। হলে নখের জীবাণু গুলো মুখের মুখের মাধ্যমে পেটের মধ্যে চলে যায়। এতে বিভিন্ন রকমের রোগ জীবাণু সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া শিশুদের নখের আঁচড়ে শিশুদের নিজেদের শরীরে আঘাত লাগতে পারে। তাই নিয়মিত তাদের হাতের নখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং কেটে ছোট রাখতে হবে।
৬. শিশুদের কান ও নাক পরিষ্কার :
বাচ্চাদের কান ও নাক পরিষ্কার করার জন্য কটন বাডস ব্যবহার করুন। বাচ্চা ঘুমিয়ে গেলে সতর্কতার সাথে কান ও নাক পরিষ্কার করুন। খেয়াল রাখুন কানের পর্দায় বা নাকের খুব বেশি ভেতরে যেন আঘাত না লাগে। পরিষ্কার করার আগে কটন বাডসে হালকা অলিভ অয়েল লাগিয়ে নিন। অনেক সময় শিশুদের নাকে সর্দি বা ময়লা জমে বন্ধ হয়ে যায়, এর ফলে শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং দুধ টানতে চায় না। সুতরাং এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকুন।
৭. কুসুম কুসুম পানিতে গোসল :
শীতকালে অন্তত এক মাস নবজাতককে সরাসরি পানিতে গোসল করানো অনুচিত। সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া বা প্রি-ম্যাচিওরড বেবিকে দুই মাস গোসল করানো ঠিক হবে না। তিন দিন পর কুসুম কুসুম গরম পানিতে শরীর হালকা মুছে দিতে পারেন। এক মাস বা দুই মাস পর সপ্তাহে এক দিন পানিতে গোসল করানো যাবে। গোসল বা গা মোছানোর পানি প্রথমে ১০ মিনিট ধরে ফুটিয়ে নিতে হবে। তারপর হালকা কুসুম গরম করে নিতে হবে। পানিতে জীবাণুনাশক তরল মেশানো যাবে না। পানি সূর্যের রোদে গরম করা হলেও হবে না। শিশুর গোসল অবশ্যই বদ্ধ কোনো ঘরে হতে হবে। এর ফলে বাতাসে নবজাতক ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হবে না।
৮. পোশাক হবে কোমল
নবজাতককে সরাসরি উলের পোশাক পরানো ঠিক নয়। চিকিৎসকরা বলেন, উলের ক্ষুদ্র লোমে অ্যালার্জি হতে পারে। সুতির পোশাকের ওপর উলের সোয়েটার চাপাতে পারেন, অন্তত তিন প্রস্থ পোশাক নবজাতককে পরাতে হয়। তা হতে পারে কাঁথা ও কম্বল। অবশ্যই তা হবে শিশুর উপযোগী।
দ্য বেবি শপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা আলী নবজাতকের উপযোগী পোশাক সম্পর্কে জানান, দেশেই পাওয়া যায় নবজাতকের ব্যবহারের উপযোগী পোশাক। এগুলো তৈরি হচ্ছে সুতি, উল ও অন্যান্য উষ্ণ কাপড়ে। নবজাতকের পোশাকের মধ্যে আছে বডি স্যুট ও রম্পার। এগুলোর মাধ্যমে জামা ও প্যান্টের কাজ একসঙ্গে চলবে। আরও আছে বেবি স্যাক। এটি অনেকটা ছালার মতো, কিন্তু কাজ করে কম্বলের। নবজাতককে সামনে থেকে খোলা যায় এমন পোশাক পরানো উচিত। বেবি স্যাকের সামনে চেইন লাগানো বলে সে সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়া নবজাতককে হাফহাতা বা ফুলহাতা সোয়েটার, টি-শার্টও পরাচ্ছেন অনেকে। শীতে নবজাতককে অবশ্যই হাতমোজা, পা-মোজা ও কানটুপি পরাতে হবে। তবে মনে রাখবেন, নবজাতকের দেহের আচ্ছাদন হিসেবে সুতি ছাড়া অন্য কোনো কাপড় লাগানো উচিত নয়। এত কিছুর পরও যদি ঠাণ্ডা লেগেই যায় নবজাতকের সর্দি মুছতে রাবারের নেজল অ্যাসপিরেটর ব্যবহার করুন এবং দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
শিশুর যত্নে সতর্কতা:
বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল মান্নান বলেন, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই প্রচলিত কিছু আচরণের কারণে শীতে নবজাতকের অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই শিশুকে গোসল করিয়ে ফেলা আমাদের দেশের চিরাচরিত দৃশ্য। কারণ নবজাতকের দেহে জন্মের পরপরই একপ্রকার সাদা আবরণ দেখা যায়। অনেকেই এটি নোংরা ভেবে মুছে দেন বা গোসল করিয়ে ধুয়ে দেন। কেউ লিকুইড প্যারাফিনেও মুছে ফেলেন। কিন্তু এটি মূলত নবজাতকের সুরক্ষা কবচ। এটি নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখে, যেকোনো জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং ত্বককে সুরক্ষা দেয়। প্রায় সবাই এক দিনের মধ্যেই মাথার চুল কামিয়ে দেন। কিন্তু কখনো কখনো এর ফলে নবজাতকের নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। চুল নবজাতকের মাথার তাপমাত্রা ধরে রাখে। খুব বেশি বড় চুল হলে এবং তাতে সমস্যা তৈরি হলে কাঁচি দিয়ে বড়জোর একটু ছেঁটে দেওয়া যাবে। রোদে দেওয়ার জন্য অনেকে নবজাতককে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে খালি গায়ে ফেলে রাখেন। শীতের ঠাণ্ডা বাতাস, কুয়াশা বা মেঘলা অবস্থায় শিশুকে বাইরে নেওয়াই অনুচিত। রোদ উঠলে ও বাতাস কম থাকলে বেলা ১২টার আগে নবজাতককে কোলে নিয়ে রোদে বসতে হবে। শরীর উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকলে একটি একটি করে অঙ্গ পুরো শরীরে রোদ লাগাতে হবে, তাও আধা ঘণ্টার বেশি নয়। বিকালের রোদ নবজাতকের শরীরে লাগানো ক্ষতিকর।
আরেকটি প্রচলিত আচরণ হলো নাভির নাড়িতে তেল মেখে রোদে রাখা। মনে রাখবেন, এতে সংক্রমণের পথই শুধু তৈরি করা হয়। নাভি থাকবে উন্মুক্ত কিন্তু যেকোনো কিছুর স্পর্শ ছাড়া। বড়জোর ঢোলা সুতির পোশাকে ঢেকে রাখা যাবে। ডায়াপার পরালে তাও থাকবে নাভির নিচে। এক ডায়াপার ৪ ঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই রাখা যাবে না।
হাড় শক্ত করতে ও শরীর গরম করতে নবজাতকের শরীরে তেল বা লোশন মালিশ করাটা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। অথচ চিকিৎসকরা বলেন, প্রথম এক মাস শিশুকে তেল, সাবান, পাউডার, লোশন, ক্রিম, কালি, কাজল কিছুই ছোঁয়ানো যাবে না। দুই থেকে তিন মাস পর অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল মালিশ করা যেতে পারে। অনেকেই উন্নতমানের ভেবে বিদেশি কোম্পানির তেল, লোশন ব্যবহার করেন। এগুলো আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্যবহারের উপযোগী কিনা দেখে নিন। এসবে শিশুর অ্যালার্জির আশঙ্কাও থাকে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন