প্রথম রোজার আনন্দ
আগামীকালকে প্রথম রোজা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজকে তাই বাড়ির সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছোটরা বড়রা সবাই রোজা রাখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাড়ির মহিলা ও মেয়েমানুষ গুলো সংসার এর নানান কাজে ব্যস্ত আছে। কেউ বাড়িঘর মুছামুছি করছে, কেউ বা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করছে, কেউ বাড়ির উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। এভাবে সবাই ব্যস্ত আছে। আর ছোটরা তাদের অভিভাবকদের কাজে সাহায্য করছে। একটি গ্রামের মধ্যে একটি ছোট বাড়ি আছে, যে বাড়ির নাম হচ্ছে মুন্সিবাড়ি। এই বাড়িটির নাম মুন্সিবাড়ি হওয়ার একটি কারণ আছে। সে কথা আজ বলবো না। এই মুন্সিবাড়িতে ছোট ছোট শিশু আছে অনেকগুলা । আসরের নামাজের শেষে বিকেল বেলা বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলো অপেক্ষায় আছে কখন শেষ সিদ্ধান্ত হয় যে আগামি কালকেই রোজা। এই রমজান মাস মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। যার কারনে এই মাস অত্যন্ত আনন্দের। যাদের বাড়িতে টেলিভিশন আছে তারা টেলিভিশনের সামনে বসে আছে, কেউ রেডিও চালু করে বসে আছে, অনেকে মসজিদের মাইকের অপেক্ষায় আছে। আর ছোট ছেলেমেয়েগুলো মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রমজান মাসের চাঁদ দেখা যায় কিনা তা দেখার জন্য। কেউ এই পাশ কেউ ওইপাশ এরকমভাবে ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খুঁজছে। এদের মধ্যে থেকে একজন বলল ওই চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এই কথাটা শোনার সাথে সাথে সব ছেলে মেয়েরা আসলো তার কাছে। বলল কোথায় চাঁদ কোথায় চাঁদ কোথায় চাঁদ দেখা যাচ্ছে। যে চাঁদ দেখতে পেরেছে সে তার হাতের ইশারা দিয়ে চাঁদ দেখিয়ে দিল। সত্যিই তো চাঁদ উঠেছে। একদম কাস্তের মতো চিকন। ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেখার মত। তাদের সবার মুখে হাসি। অন্তরে আনন্দ! সবাই দল ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলা শুরু করল যে তারা চাঁদ দেখেছে। চাঁদ দেখার খুশিতে আজকে তাঁদের পড়াশোনা মাপ। ছেলেমেয়েরা খুব মজা করে আড্ডা দিচ্ছে। একবার এক বাড়িতে কিছুক্ষণ আড্ডা আরেকবার আরেক বাড়িতে কিছুক্ষণ আড্ডা এভাবে তারা খুব মজা করে সময় পার করলো। ঘন্টা দু -এক যেতেই মসজিদের আওয়াজ আসছে পবিত্র রমজানের শুভেচ্ছা সবাইকে, সবাই মসজিদে আসুন, এই ক্ষমার মাসে নিজেকে পাপ মুক্ত করার জন্য মসজিদে আসুন, তারাবিহ এর নামাজের জন্য মসজিদে আসুন।
আজ প্রত্যেকটি মুসলমান পুরুষ মসজিদে যাচ্ছে তারাবিহ পড়ার জন্য, সাথে কারো ছোট্ট ছেলে কিংবা নাতি নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সবার হাতেই আছে জায়নামাজ। মসজিদের সামনে আসতেই কি সুন্দর দৃশ্য। আলহামদুলিল্লাহ, সবাই মসজিদের টিউবওয়েল এ ওযু করছে, একজন টিউবওয়েল চাপ দিচ্ছে আর চার পাঁচ জন ওযু করছে। মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করলে আরো সৌন্দর্য দেখা যায়। সারি করে জায়নামাজ গুলো বিছানো আছে। ছোট বড় পুরুষ মানুষ দিয়ে মসজিদটি ভর্তি। দেখলে মনে হয় সত্যিই এ মাসটি বরকতময় মাস। সারা বছর যে মসজিদে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়না, কোন কোন সময় ইমাম একা ফরজ নামাজ পরে, সেই মসজিদেই এই রমজানের বাতাস লেগে মানুষ জনে ভরে গেছে। এ দৃশ্য দেখে কার না ভালো লাগবে।
তবে অবাক করার বিষয় হলো, নামাজের শুরুতে লোক ৫০ জন হলেই শেষে কিন্তু ২০/২৫ জনই ছিল। বাকি সবাই অর্ধেক নামাজ পরে পেছন থেকে চলে গেছে। এভাবেই তারাবিহ এর নামাজ শেষ করে সবাই বাড়ি চলে এলো।
সবাই যার যার বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা সবার বাবা মাকে বারবার করে সাবধান করে দিলো, আদেশ দিল, অনুরোধ করলো তাদের যেন ঘুম থেকে ডেকে তুলে সেহরি খাওয়ার জন্য । তারা সবাই যার যার বাবা মাকে রাজি করিয়ে তারপর শুয়ে পড়লো। যদি ছেলেমেয়েদের বাবা মা তাদের ডাক না দেয় সেই ভয়ে অনেকের ঘুমই আসছিলনা। অবশেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। নিথর রাত। বিশ্রামের রাত সবাই ঘুমিয়ে আছে। শুধু মানুষ নয়, সব কিছুই ঘুমিয়ে আছে। মাঝরাতে চারদিকের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনেন শব্দ ভেসে আসছে। 'সম্মানিত মা ও বোনেরা, আপনারা সবাই ঘুম থেকে উঠুন, সেহরি রান্না করুন, সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে ' বার বার এভাবে সবাইকে মসজিদের মাইকের মাধ্যমে ডেকে দিচ্ছে মুয়াজ্জিন। কখনো আবার অনেক সময় ধরে গজল বলে যাচ্ছে মিষ্টি সুরে। অন্ধকার রাত। মায়েরা রান্না করছে, আর মেয়েরা তাঁদের সাহায্য করছে। একজন আগে উঠতে পারলে সে বাড়ির সবাইকে ডেকে তুলছে। ছেলেমেয়েদের ঘুম ভেঙে গেল হাঁড়ি পাতিলের টিং টং আওয়াজ শুনে। ঘুম থেকে শিশুরা উঠে মুখ চোখ ঘষছে। রান্না শেষ হলে সবাই এক সঙ্গে খেতে বসলো যা অন্য সময় হয় না। যাদের টিভি আছে তারা টিভি চালু করে বসে বসে গজল শুনছে, অনেকে একই কাজ করছে রেডিওর মাধ্যমে। আর যাদের কিছুই নেই তারা এবাড়ি ওবাড়ির খবর নিচ্ছে। তারাবিহ এর মতো সাহরি শেষ করে মসজিদে যাওয়ার পর্ব। ফজরের নামাজ পড়তে হবে। সাওম এর মতো নামাজটাও যে ফরজ এ ব্যাপারে কারো কারো গুরুত্ব কম। তাই তারাবিহ এর মতো সবাই ফজর নামাজ পড়তে মসজিদে যায় না। সারাদিন বিভিন্ন ভাবে কেটে গেলেও শিশুদের অনেকের আছে তারা এক দিনে তিনটি রোজা করে ফেলেছে। আবার অনেকে আছে বাবা মা গালাগালি করার পরেও খায়নি বা রোজা ভাঙেনি। তাঁদের মনে একটু বেশিই আনন্দ। তারা বড়দের মতো রোজা রাখতে পেরেছে। ইফতারের সময় কারো মুখই তরতাজা দেখাচ্ছে না। ছোটদের মুখগুলো শুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের মনে আনন্দ। সাহরির মতো ইফতারটাও মায়েরা তৈরী করছে আর মেয়েরা সাহায্য করছে। যার যেমন সামর্থ সে তেমন করে ইফতারের তালিকা করেছে। তবে জনপ্রিয় কিছু জিনিস আছে যা সবার বাড়িতে পাওয়া যায় তাহলো সোলা, পিঁয়াজি, শরবত, খেজুর, মুড়ি ইত্যাদি। ইফতারের অন্তিম মুহূর্তে সবাই খাবার নিয়ে বসে আছে। কখনো সময় হবে। কখন আজান হবে। আল্লাহ তালার প্রতি মুসলমানদের কত গভীর বিশ্বাস। চোখের সামনে কত প্রকারের খাবার, অথচ কেউ খাচ্ছে না, খেলেই বা কি হবে, তবু খাচ্ছে না, সারাটা দিন না খাওয়া, পিপাসায় গলাটা ফেটে যাচ্ছে, হাতের কাছেই পাত্র ভর্তি পানি, তবু খাচ্ছে না। কারন একটাই, যে আল্লাহ তালার হুকুমে ফজরের আগে থেকে মাগরিব পর্যন্ত না খাওয়া সহ কত খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে সেই আল্লাহর হুকুম মতোই খাবার খাবে। ১ সেকেন্ড আগেও যেন খাবার খাওয়া না হয় সে ব্যাপারে সবাই সচেতন। কত গভীর বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার উপর। নির্দিষ্ট সময় হওয়ার সাথে সাথে সবাই খাবার শুরু করলো। রমজান মাস, রোজা, তারবিহ, সাহরি, ইফতার নামগুলো কানে আসলেই মনটা আনন্দে নেচে উঠে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন