কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত, শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. এর ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
শাইখ আহমাদুল্লাহ, রেজাউল করিম আবরার, কবর জিয়ারত
তথ্যগুলো রেজাউল করিম আবরার সাহেবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত, শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. এর ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত, শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. এর ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
রেজাউল কারীম আবরার
আমরা প্রত্যেকেই আমাদের মৃত আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করি। জিয়ারতে গিয়ে প্রথমে সালাম দিয়ে সাধ্যমত কুরআন তেলাওয়াত করি। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আয়াত কিংবা সূরা পড়ার চেষ্টা করি।
শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. কে প্রশ্ন করা হয় যে, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা, ইখলাস, দুরুদে ইবরাহিমি পড়ে মুনাজাতের বিধান কী? জবাবে তিনি বলেছিলেন, এটা ইসলাম সমর্থন করে না। আমাদের দেশে যেভাবে মানুষ করবস্থানে গিয়ে সুরা ফাতেহা একবার, সুরা ইখলাস তিনবার পড়ে, এগুলো মেড ইন চায়না। এরপর মেড ইন মদিনার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘করবস্থানে গিয়ে সালাম দিবেন। এর বেশি কিচ্ছু নাই। এরপর আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে বলেন, কবরস্থানে গিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করার কোন দরকার নেই।”
আসুন কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে কিনা? এ ব্যাপারে মাজহাবের ইমামগণ কী বলেন? হাম্বিলি মাজহাব বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কুদামা মাকদিসি রাহি. বলেন:
[فَصْلُ الْقِرَاءَةِ عِنْدَ الْقَبْرِ]
فَصْلٌ: قَالَ: وَلَا بَأْسَ بِالْقِرَاءَةِ عِنْدَ الْقَبْرِ، وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أَحْمَدَ أَنَّهُ قَالَ: إذَا دَخَلْتُمْ الْمَقَابِرَ اقْرَءُوا آيَةَ الْكُرْسِيِّ وَثَلَاثَ مَرَّاتٍ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ، ثُمَّ قُلْ: اللَّهُمَّ إنَّ فَضْلَهُ لِأَهْلِ الْمَقَابِرِ. وَرُوِيَ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: الْقِرَاءَةُ عِنْدَ الْقَبْرِ بِدْعَةٌ، وَرُوِيَ ذَلِكَ عَنْ هُشَيْمٍ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ: نَقَلَ ذَلِكَ عَنْ أَحْمَدَ جَمَاعَةٌ، ثُمَّ رَجَعَ رُجُوعًا أَبَانَ بِهِ عَنْ نَفْسِهِ، فَرَوَى جَمَاعَةٌ أَنَّ أَحْمَدَ نَهَى ضَرِيرًا أَنْ يَقْرَأَ عِنْدَ الْقَبْرِ، وَقَالَ لَهُ: إنَّ الْقِرَاءَةَ عِنْدَ الْقَبْرِ بِدْعَةٌ. فَقَالَ لَهُ مُحَمَّدُ بْنُ قُدَامَةَ الْجَوْهَرِيُّ: يَا أَبَا عَبْدِ اللَّهِ: مَا تَقُولُ فِي مُبَشِّرٍ الْحَلَبِيِّ؟ قَالَ: ثِقَةٌ.
قَالَ: فَأَخْبَرَنِي مُبَشِّرٌ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّهُ أَوْصَى إذَا دُفِنَ يُقْرَأُ عِنْدَهُ بِفَاتِحَةِ الْبَقَرَةِ وَخَاتِمَتِهَا، وَقَالَ: سَمِعْت ابْنَ عُمَرَ يُوصِي بِذَلِكَ. قَالَ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ: فَارْجِعْ فَقُلْ لِلرَّجُلِ يَقْرَأُ.
অর্থাৎ এ পরিচ্ছেদ হলো কবরে কুরআন তেলাওয়াত সংক্রান্ত। কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করতে কোন সমস্যা নেই। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, “তোমরা যখন কবরস্থানে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা আয়াতুল কুরসি এবং তিনবার সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করবে।
বর্ণিতে হয়েছে যে, তিনি কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করাকে বেদআত মনে করতেন। কিন্তু পরে তিনি সে মত থেকে ফিরে এসেছেন। বিশাল একদল আলেম বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আহমদ একজন অন্ধ ব্যক্তিকে কবরস্থানে তেলাওয়াত করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, কবরস্থানে তেলাওয়াত করা বেদআত। মুহাম্মাদ বিন কুদামা আল জাওহারি তখন ইমাম আহমদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মুবাশশির আল হালাবির ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি বললেন, উনি বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য। তখন মুহাম্মাদ বিন কুদামা বললেন, আমাকে তিনি তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তার পিতা মৃত্যুর সময় ওসিয়ত করে গেছেন, যেন তার কবরের পাশে সূরা বাকারার প্রথমাংশ এবং শেষাংশ তেলাওয়াত করা হয়। এরপর তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর রাযি. কে এ ধরণের ওসিয়ত করতে শুনেছি।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহি. তখন বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে ওই লোককে কুরআন তেলাওয়াত করতে বলো। (আল মুগনি: ২/৪২২)
হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম শামছুদ্দীন আল মাকদিসি রাহি. বলেন:
مسألة: (ولا تُكْرَهُ القِراءَةُ على القَبْرِ، في أصَحِّ الرِّوايَتَيْن) هذا هو المَشْهُورُ عن أحمدَ، فإنَّه رُوِىَ عنه، أنَّه قال: إذا دَخَلْتُم المَقابِرَ اقْرَأُوا آيَةَ الكُرْسِىِّ، وثَلاثَ مِرارٍ {قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ}،
বিশুদ্ধ মতানুসারে করবস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা মাকরুহ নয়। এটা হলো ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহি. এর প্রসিদ্ধ মত। কারণ, তার থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তোমরা যখন কবরস্থানে প্রবেশ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি এবং তিনবার সূরা ইখলাস পড়বে। (আশ শারহুল কাবীর: ৬/২৫৬)
এবার আমরা ফিকহে হানাফির ফতোয়া দেখব। ‘মাজমাউল আনহুর’ এর বলা হয়েছে:
(وَكَرِهَ الْإِمَامُ الْقِرَاءَةَ عِنْدَ الْقَبْرِ) لِأَنَّ أَهْلَ الْقَبْرِ جِيفَةٌ وَكَذَا يُكْرَهُ الْقُعُودُ عَلَى الْقَبْرِ لِأَنَّهُ إهَانَةٌ (وَجَوَّزَهَا) أَيْ الْقِرَاءَةَ عِنْدَ الْقَبْرِ (مُحَمَّدٌ وَبِهِ) أَيْ يَقُولُ مُحَمَّدٌ (أَخْذٌ) لِلْفَتْوَى لِمَا فِيهِ مِنْ النَّفْعِ
অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা রাহি. এর মতে কবরস্থানে তেলাওয়াত করা মাকরুহ। ইমাম মুহাম্মাদ রাহি. এর মতে জায়েজ। ইমাম মুহাম্মাদ রাহি. এর মতের উপর হলো ফতোয়া। কারণ, তেলাওয়াতের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয়। (মাজমাউল আনহুর: ২/৫৫২)
ইবনে নুজাইম রাহি. বলেন:
عَلَى قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ بِكَرَاهَةِ الْقِرَاءَةِ عِنْدَ الْقَبْرِ فَلِذَا يَبْطُلُ التَّعْيِينُ وَالْفَتْوَى عَلَى قَوْلِ مُحَمَّدٍ مِنْ عَدَمِ كَرَاهَةِ الْقِرَاءَةِ عِنْدَهُ
অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফার মতানুসারে কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা মাকরুক। কিন্তু ফতোয়া হলো ইমাম মুহাম্মাদ রাহি. এর মতের উপর। কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা মাকরুহ নয়। (আল বাহরুর রায়েক: ৫/২৪৬)
ইবনে আবিদিন শামি রাহি. বলেন:
وَفِي شَرْحِ اللُّبَابِ وَيَقْرَأُ مِنْ الْقُرْآنِ مَا تَيَسَّرَ لَهُ مِنْ الْفَاتِحَةِ وَأَوَّلِ الْبَقَرَةِ إلَى الْمُفْلِحُونَ وَآيَةِ الْكُرْسِيِّ – وَآمَنَ الرَّسُولُ – وَسُورَةِ يس وَتَبَارَكَ الْمُلْكُ وَسُورَةِ التَّكَاثُرِ وَالْإِخْلَاصِ اثْنَيْ عَشَرَ مَرَّةً أَوْ إحْدَى عَشَرَ أَوْ سَبْعًا أَوْ ثَلَاثًا، ثُمَّ يَقُولُ: اللَّهُمَّ أَوْصِلْ ثَوَابَ مَا قَرَأْنَاهُ إلَى فُلَانٍ أَوْ إلَيْهِمْ. اهـ. مَطْلَبٌ فِي الْقِرَاءَةِ لِلْمَيِّتِ وَإِهْدَاءُ ثَوَابِهَا لَهُ
অর্থাৎ ‘শারহুল লুবাব’ এ রয়েছে, কবরস্থানে সামর্থনুযায়ী সুরা ফাতেহা, সুরা বাকার শুরুর অংশ মুফলিহুন পর্যন্ত, আয়াতুল কুরসি, আমানার রাসুসল, সুরা ইয়াসিন, সুরা মুলক, সুরা তাকাসুর, সুরা ইখলাস ১২ বার, কিংবা ১১ বার, কিংবা ৭ বার, কিংবা ৩ বার পড়বে। এরপর বলবে, হে আল্লাহ আমার তেলাওয়াতের সাওয়াব অমুকের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। (রাদ্দুল মুহতার: ২/২৪৩)
এবার আমরা এ ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি রাহি. এর মতামত জানব।
فَأَمَّا الْقِرَاءَةُ عِنْدَ الْقَبْرِ فَقَدْ قَالَ الشَّافِعِيُّ: وَرَأَيْتُ مَنْ أَوْصَى بِالْقِرَاءَةِ عِنْدَ قَبْرِهِ وَهُوَ عِنْدَنَا حَسَنٌ.
অর্থাৎ কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি রাহি. বলেন, আমি দেখিছি যারা কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াতের ওসিয়ত করে। এটা আমাদের মতে উত্তম কাজ। (আল হাওয়ী আল কাবীর: ৩/২৬
)
স্বীকৃত তিন ফিকহ অনুযায়ী কবস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে। শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. ফিকহে হানাফির স্বীকৃত কোন আমল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে উদাঁরতা বুঝানোর জন্য বিন বাজ, উসাইমিন, রাহি. এর বিপরিত মত টেনে আনেন।
অথচ এ মাসআলায় তিনি তাদের মতানুসারে ফতোয়া দিয়েছেন। এর বিপরিত তিনি ফিকহে হানাফি, ফিকহে হাম্বলি এবং ফিকহে শাফেয়িকে টেনে আনার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। অথচ এ দেশের ৯৯ পার্সেন্ট মানুষ ফিকহে হানাফির অনুসারী! তাদের মতামতকে চূড়ান্ত মনে করে তিনি বলে দিয়েছেন, ‘করবস্থানে গিয়ে সালাম দিবেন। এর বেশি কিচ্ছু নাই। এরপর আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে বলেন, কবরস্থানে গিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করার কোন দরকার নেই!
প্রিয় পাঠক, এ সংক্রান্ত শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. ফতোয়া শুনে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। কবরস্থানে গিয়ে নিজের সাধ্যানুযায়ী কুরআন তেলাওয়াত করবেন। সালামের বেশি কিচ্ছু নাই বলে তিনি যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন, শাস্ত্রীয় মানদণ্ডে এগুলো একেবারেই দুর্বল। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। ইনসাফের সাথে ফতোয়া প্রদানের তাওফিক দান করুন।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন